বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব- Bangla Sahitter Poncho Pandob Kobi
ইংরেজি কবিতার অনুবাদ করে, গঠন প্রকৃতি, ধরন প্রভৃতি অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যে যে নতুন কবিতার ধারা সৃষ্টি হয়, সেসকল কবিতাকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতা বলা হয়। আর এই আধুনিক কবিতা রচনা শুরু করেন যারা তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য (প্রধান) ৫ জন কবিদেরকে একত্রে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ বলা হয়। আধুনিকতাবাদী পঞ্চপাণ্ডবগন সকলে ছিলেন ত্রিশ দশকের কবি।
বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব কবিদের নাম
পঞ্চপাণ্ডব কবিদের নাম: জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, এবং অমিয় চক্রবর্তী।
বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডব কবি: জীবনানন্দ দাশ
১) জীবনানন্দ দাশ : জন্ম- ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার ধানসিঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। জীবনানন্দ দাশ মৃত্যু – ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর, ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে, কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উপাধি : নির্জনতম কবি – আখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। এছাড়াও তার আরও কিছু উপাধি হলো: তিমির হননের কবি, ধূসরতার কবি, রূপসী বাংলার কবি, জনবিচ্ছিন্ন কি, প্রকৃতির কবি, শুদ্ধতম কবি ইত্যাদি।
- জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে গবেষণা করেন – মার্কিন গবেষক ক্লিনটন বুথ সিলি।
- জীবনানন্দ দাশের মা – একজন বিখ্যাত কবি কুসুমকুমারী দাশ
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনানন্দের কবিতাকে ‘চিত্ররূপময় কবিতা’ বলেছেন।
জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম:
কাব্যগ্রন্থ:
১) ঝরাপালক : কবির প্রকাশিত প্রথম কবিতা। ১৯২৭ সালে এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
২) বনলতা সেন : ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়। এটি এডগার এলেন পো রচিত ‘টু হেলেন’ কবিতা অবলম্বনে রচিত। বনলতা সেন কাব্যের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২টি কবিতা হলো-
- বনলতা সেন : কয়েকটি লাইন এরূপ- সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মালয় সাগরে…….., পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে বলেছিল নাটরের বনলতা সেন……., চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা……
- হায় চিল : আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।
৩) ধূসর পাণ্ডুলিপি,
৪) সাতটি তারার তিমির : কাব্যের বিখ্যাত কবিতা ‘আকাশলীনা’। আকাশলীনা কবিতার বিখ্যাত ২টি লাইন : সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে…
৫) বেলা অবেলা কালবেলা,
৬) মহাপৃথিবী,
৭) রূপসী বাংলা – এই কাব্যগ্রন্থের জন্য জীবনানন্দ দাশকে রূপসী বাংলার কবি বলা হয়েছে। রূপসী বাংলা কাব্যটি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটি ‘স্বদেশ প্রীতি ও নিসর্গময়তার পরিচায়ক’। রূপসী বাংলা কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হলো : আবার আাসিব ফিরে, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, সেই দিন এই মাঠ প্রভৃতি। কবিতাগুলোর লাইনগুলো নিম্নে বর্ননা করা হলো:
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি : বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না আর : অন্ধকারে.
আবার আসিব ফিরে : আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়ির তীরে – এই বাংলায় হয়তে মানুষ নয় হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে….
উপন্যাস : ১) মাল্যবান, ২) সতীর্থ, ৩) কল্যাণী।
প্রবন্ধ গ্রন্থ : ১) কবিতার কথা, ২) কেন লিখি।
গল্প সংগ্রহ : জীবনানন্দ দাশের গল্প।
বিখ্যাত কবিতাগুলো হলো : বনলতা সেন, অবসরের গান, পেঁচা, হায়চিল, বোধ ইত্যাদি।
বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডব কবি: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
২) সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : জন্ম- ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর, কলকাতার হাতীবাগানে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ২০জুন, ১৯৬০ সালে মৃত্যুবরন করেন।
উপাধি: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘ক্লাসিক কবি’ হিসেবে স্বীকৃত।
সম্পাদিত পত্রিকা : ১৯৩১ সালে ‘পরিচয়’ নামক ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
কাব্যগ্রন্থ :
১) তন্বী – সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম কাব্য। এটি ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়। ‘তন্বী’ কাব্যটিকে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন।
২) ক্রন্দসী – কাব্যের কবিতা : ‘উটপাখি’। উটপাখি কবিতাটির বিখ্যাত লাইন – অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
৩) প্রতিদিন, ৪) উত্তর ফাল্গুনী, ৫) সংবর্ত, ৬) দশমী,
৭) প্রতিধ্বনি : এটি একটি অনুবাদ কাব্য।
৮) অর্কেস্ট্রা।
গল্পগ্রন্থ : সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ২টি গল্পগ্রন্থ রয়েছে। ১) স্বগত ২) কুলায় ও কালপুরুষ।
প্রবন্ধ : কাব্যের মুক্তি – কাব্যের মুক্তি প্রবন্ধটিকে আধুনিক বাংলা কবিতার ইশতেহার হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডব কবি: অমিয় চক্রবর্তী
৩) অমিয় চক্রবর্তী : জন্ম- ১৯০১ সালের ১০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে। মৃত্যু- ১৯৮৬ সালে মৃত্যুবরন করেন।
- অমিয় চক্রবর্তী ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ সাহিত্য সচিব ছিলেন।
- ১৯৬০ সালে ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ পান।
- ১৯৭০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন।
কাব্যগ্রন্থ :
১) খসড়া – অমিয় চক্রবর্তীর প্রথম প্রকাশিত কাব্য।
২) অনিঃশেষ – কাব্যটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। ‘অনিঃশেষ’ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা – ‘বাংলাদেশ’। অমিয় চক্রবর্তীর বাংলাদেশ কবিতাটি: অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। এই কবিতাটিতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ৪ বার উল্লেখিত হয়েছে।
৩) পালাবদল, ৪) মাটির দেয়াল, ৫) এক মুঠো, ৬) পারাপার , ৭) দূরবাণী, ৮) পুষ্পিত ইমেজ, ৯) হারানো অর্কিড, ১০) অভিজ্ঞান বসন্ত, ১১) ঘরে ফেরার দিন, প্রভৃতি।
প্রবন্ধ : ১) সাম্প্রতিক, ২) পথ অন্তহীন, ৩) চলো যাই, ৪) পুরবাসী।
৪) বুদ্ধদেব বসু : জন্ম- ১৯০৮ সালের, ৩০ নভেম্বর, কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যু- ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরন করেন।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে পরিচিত।
সম্পাদিত পত্রিকা : ১) প্রগতি, ২) চতুরঙ্গ, ৩) কবিতা,
৪) বাসন্তিকা – এই পত্রিকাটি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে থাকা অবস্থায় সম্পাদনা করতেন।
কাব্যগ্রন্থ : ১) মরচেপড়া পরেকের গান, ২) মর্মবাণী, ৩) কঙ্কাবতী, ৪) দময়ন্তী,
৫) বন্দীর বন্দনা, ৬) স্বাগত বিদায়।
প্রবন্ধ : ১) হঠাৎ আলোর ঝলকানি, ২) কালের পুতুল, ৩) স্বদেশ ও সংস্কৃতি , ৪) সাহিত্য চর্চা
৫) রবীন্দ্রনাথ : কথা সাহিত্য,
৬) কবি রবীন্দ্রনাথ,
৭) সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ।
উপন্যাস : ১) গোলাপ কেন কালো, ২) তিথিডোর, ৩) নীলাঞ্জনের খাতা, ৪) নির্জন স্বাক্ষর, ৫) রাতভর বৃষ্টি,
৬) রুকমি, ৭) পরিক্রমা, ৮) কালো হাওয়া, ৯) সাড়া, ১০) লালমেঘ, ১১) পাতাল থেকে আলাপ, ১২) সানন্দা, প্রভৃতি।
অনুবাদ গ্রন্থ : মেঘদূত। (মূল রচয়িতা : মহাকবি কালিদাস)।
নাটক : ১) কলকাতার ইলেক্ট্রা ও সত্যাসন্ধ, ২) তপস্বী ও তরঙ্গিণী, ৩) মায়া মালঞ্চ।
গল্পগ্রন্থ : ১) একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু, ২) রেখাচিত্র, ৩) অভিনয় , ৪) হাওয়া বদল, ৫) ভাসো আমার ভেলা, ৬) হৃদয়ের জাগরণ, ৭) অভিনয় নয়।
স্মৃতিকথা : ১) আমার যৌবন, ২) আমার ছেলেবেলা।
ভ্রমণ কাহিনি : ১) জাপানি জার্নাল, ২) সব পেয়েছির দেশে, ৩) দেশান্তর।
বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডব কবি: বিষ্ণু দে
৫) বিষ্ণু দে : জন্ম- বিষ্ণু দে ১৯০৯ সালের ১৮ জুলাই কলকাতার পটলডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যু- তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
- পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবিতা রচনা করেন কবি বিষ্ণু দে।
- মার্কসবাদী কবি বা ‘মার্কসিস্ট’ কবি নামে খ্যাত।
- বাংলায় টি.এস.এলিয়টের কবিতার দ্বিতীয় অনুবাদক। (প্রথম অনুবাদক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
- ‘এলিয়টের কবিতা’ নামক একটি অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন। এটি ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় ।
সম্পাদিত পত্রিকা : ১) সাহিত্যপত্র, ২) নিরুক্তা।
কাব্যগ্রন্থ : ১) উর্বশী ও আর্টেমিস – কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্য।
২) তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ, ৩) চোরাবালি, ৪) সাতভাই চম্পা, ৫) আমার হৃদয়ে বাঁচো, ৬) সন্দীপের চর,
৭) নাম রেখেছি কোমল গান্ধার, ৮) উত্তরে থাকে মৌন, ৯) চিত্ররূপমত্ত পৃথিবী, ১০) স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যৎ, ইত্যাদি।
প্রবন্ধ : ১) সাহিত্যের ভবিষ্যৎ, ২) রুচি ও প্রগতি, ৩) সাধারণের রুচি, ৪) এলোমেলো জীবন ও শিল্প সাহিত্য।
স্মৃতিকথা : ছড়ানো এই জীবন।
বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডব কবি থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নাবলী :
বিগত বছরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ‘পঞ্চপাণ্ডব‘ থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নাবলী :
১) পঞ্চপাণ্ডব বলা হয় কাদের? উ: তিরিশ দশকের ৫ জন কবিদের পঞ্চপাণ্ডব বলা হয়। তারা হলেন- জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে।
২) তিরিশ দশকের সবচেয়ে ‘তথাকথিত’ কোন গণবিচ্ছিন্ন কবি এখন বেশ জনপ্রিয়? উ: জীবনানন্দ দাশ।
৩) কার কবিতাকে ‘চিত্ররূপময়’ বলা হয়েছে? উ: জীবনানন্দ দাশ।
৪) ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন কোন দুজন কবি? উ: কাজী নজরুল ইসলাম, ও জীবনানন্দ দাশ।
৫) জীবনানন্দ দাশের অনুবাদ কাব্যের নাম কি? উ: মহাপৃথিবী।
৬) পঞ্চপাণ্ডবের কোন কবি কখনো উপন্যাস লেখেন নি? উ: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
৭) ‘অন্ধ হলে প্রলয় কি বন্ধ থাকে’ পঙক্তির স্রষ্টা কে? উ: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
৮) ‘তন্বী’ কাব্যের কবি কে? উ: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
৯) ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটি কার লেখা? উ: অমিয় চক্রবর্তী।
১০) ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটি অমিয় চক্রবর্তীর কোন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত? উ: অনিঃশেষ।
১১) ‘কবিতা’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন কে? উ: বুদ্ধদেব বসু।
১২) ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ কোন জাতীয় রচনা? উ: প্রবন্ধগ্রন্থ।
১৩) ‘তিথিডোর’ উপন্যাসের রচয়িতা? উ: বুদ্ধদেব বসু।
১৪) ‘কালের পুতুল’ কোন ধরনের রচনা? উ: প্রবন্ধ।
১৫) জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধগ্রন্থ কোনটি? উ: কবিতার কথা, কেন লিখি।
১৬) জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ কোনটি? উ: ঝরাপালক।
১৭) ‘মাল্যবান’ কোন ধরনের রচনা? উ: জীবনানন্দ দাশ রচিত উপন্যাস।
১৮) জীবনানন্দের ‘আকাশলীনা’ কবিতাটি কোন কাব্যের অন্তর্ভুক্ত? উ: সাতটি তারার তিমির।
১৯) ‘সোনার স্বপ্নে সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে’ কবিতাংশটি কার লেখা? উ: জীবনানন্দ দাশ।
২০) ‘নির্জন স্বাক্ষর’ উপন্যাসের লেখক কে? উ: বুদ্ধদেব বসু।